টেলিস্বাস্থ্য; ডিজিটাল মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা
টেলিস্বাস্থ্য; ডিজিটাল মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাঃ
টেলিস্বাস্থ্য বলতে বর্তমান যুগে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনেক ধরনের প্রযুক্তিগত সমাধানকে বোঝানো হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চিকিৎসকগণ রোগীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ইমেইল এর ব্যবহার করেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা রোগীদের জন্য ঔষধ পত্র লিখে দেওয়া ছাড়াও অন্যান্য সেবা গুলো দিয়ে থাকেন দূরবর্তী দূরত্ব সত্বেও।
টেলিস্বাস্থ্য হচ্ছে টেলি যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সেবা ও তথ্য প্রদান করা। টেলিস্বাস্থ্য সেবা রোগী এবং চিকিৎসক বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে টেলিফোনে কথাবার্তার মতো যতটা সহজ হতে পারে ঠিক ততটাই জটিল হতে পারে যদি এক দেশ থেকে কোন চিকিৎসক ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে তার সেবা অন্য কোন দেশের রোগীকে প্রদান করেন। মাঝেমধ্যে টেলিস্বাস্থ্যকে রোবটিক প্রযুক্তির মতো জটিল আকারে দেখা দিতে আবিষ্কার করা যায়।
টেলিস্বাস্থ্য হচ্ছে মূলত টেলিমেডিসিনের সম্প্রসারণ। টেলিমেডিসিন মূলত চিকিৎসা মূলক পদক্ষেপের উপর জোর দেয়। তবে টেলিস্বাস্থ্য এই চিকিৎসা মুলক একমুখী দিকের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে এর আওতা, প্রতিরোধমূলক, উৎসাহমূলক এবং প্রতিষেধক দিকগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে। টেলি স্বাস্থ্য মূলত টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত স্বাস্থ্য এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমকে বোঝানো হতো।
টেলিস্বাস্থ্য প্রযুক্তির ক্লিনিক্যাল ব্যবহারঃ
টেলি স্বাস্থ্য প্রযুক্তির ক্লিনিক্যাল ব্যবহারসমূহ নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
১। রোগ নিরূপণ পদ্ধতির মাধ্যমে মেডিকেল চিত্র প্রেরণ করা। এর মাধ্যমে মূলত টেলিস্বাস্থ্যকে কোন জায়গায় সংরক্ষন করে অন্য জায়গায় তা প্রেরণ করা হয়।
২। ব্যক্তিবর্গ কিংবা দলের সদস্য গণ স্বাস্থ্যসেবা বিনিময় করে অথবা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে লাইভ শিক্ষা চর্চা করেন।
৩। রোগ নিরূপণের জন্য স্বাস্থ্য উপাত্তগুলো প্রেরণ করা অথবা রোগ নিরাময়ের জন্য এটাকে অনেক সময় দূর তদারকি অথবা রিমোট মনিটরিং হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।
৪। রোগীর অবস্থা তদারকি ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে রোগের প্রতিরোধ করা অথবা স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটানো।
৫। জরুরি অবস্থায় টেলিফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরামর্শ দেওয়া। একে অনেক সময় টেলিটারেজ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়।
টেলিস্বাস্থ্য প্রযুক্তির নন-ক্লিনিক্যাল প্রয়োগঃ
টেলিস্বাস্থ্য প্রযুক্তির নন-ক্লিনিক্যাল প্রয়োগসমূহনিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
১। মাঝেমধ্যে এই প্রযুক্তির কল্যাণে মেডিকেল শিক্ষায় দূরশিক্ষণ চর্চা করা হয়। এর মাধ্যমে রোগীর আচারণ ও সেবা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়।
২। প্রশাসনিক ব্যবহার যেমন- টেলিস্বাস্থ্য নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণের মাধ্যমে তদারকি এবং স্বাস্থ্যসেবার উপস্থাপন।
৩। টেলিস্বাস্থ্যের উপর গবেষণা।
৪।অনলাইন তথ্য এবং স্বাস্থ্য উপাত্ত ব্যবস্থাপনা।
৫। স্বাস্থ্য পরিচর্যায় ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় সাধন।
৬। রোগীর গতি-প্রকৃতি অনুসরণ করা এবং রোগীকে চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট কোন প্রকারভেদে ফেলা।
৭। সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাপনা।
৮। রোগীর চলাফেরা এবং দূরবর্তী ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।
টেলিস্বাস্থ্যের ধরনঃ
টেলি যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সেবা ও তথ্য প্রদান করাকে টেলিস্বাস্থ্য বলে। নিম্নে টেলিস্বাস্থ্যের প্রকারভেদ আলোচনা করা হলোঃ
ক) সংরক্ষণ এবং সম্প্রচার এর মাধ্যমে টেলিস্বাস্থ্যসেবাঃ
এই পদ্ধতিতে ডিজিটাল ইমেজ, ভিডিও, অডিও এবং ক্লিনিক্যাল উপাত্তগুলো সংগ্রহ করে এক জায়গায় সংরক্ষণ করা হয়। বিশেষ করে গ্রাহকের কম্পিউটারে। তারপর কোন এক সুবিধাজনক সময়ে নিরাপত্তা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার পর এগুলোকে ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যা অন্য জায়গায় অবস্থিত। ওই ক্লিনিকে যাবতীয় তথ্য গুলো পৌঁছার পর সেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ গবেষণা করেন।
অতঃপর তাদের মতামতগুলো যে জায়গা থেকে তথ্যগুলো প্রেরণ করা হয়েছে সেখানেই উত্তর হিসেবে পুনরায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২ থেকে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগে। এই ধরনের বিদ্যাকে রেডিওলজি বলা হয়। তাছাড়া এই পদ্ধতির মাধ্যমে ডেরমাটলজি,রেডিওলজি এবং প্যাথলজি প্রকৃতির চিকিৎসা সেবাগুলো দেওয়া হয়।
খ) রিয়েল টাইম টেলিস্বাস্থ্যঃ
রিয়েল টাইম টেলিস্বাস্থ্য পদ্ধতির আওতায় টেলিযোগাযোগ এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক মিথস্ক্রিয়া চর্চা করা হয়। এই ধরনের পদ্ধতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভিডিও কনফারেন্সিং এর ব্যবহার করা হয়। ভিডিও কনফারেন্সিং এর সময় অন্যান্য প্রযুক্তিরও সাহায্য নেয়া যেতে পারে। মাঝেমধ্যে দ্বিমুখী শ্রোতা প্রযুক্তির মাধ্যমেও এই ধরনের স্বাস্থ্যসেবা চর্চা করা হয়। এই ধরনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রচলিত হলে চিকিৎসার খরচ অনেক কমে যায় বলে বিশেষজ্ঞগণ মত প্রকাশ করেন।
বাস্তবে ক্লিনিক্যাল টেলিস্বাস্থ্য বলতে বর্তমানে যে বিষয়গুলোকে বোঝায় সেগুলো হচ্ছেঃ
১।টেলি মানসিক স্বাস্থ্য- গ্রাহক যদি মানসিক রোগী হয় তাহলে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে তাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংস্পর্শে আসার সুযোগ দেওয়া হয়।
২। টেলি পুনর্বাসন।
৩। টেলি হৃদরোগ সেবা
৪। টেলি মস্তিষ্ক রোগ সেবা।
৫। টেলি রেডিওলজি।
৬। টেলি দন্ত চিকিৎসা।
এই ধরনের বাস্তব টেলিস্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য ইন্টারনেটে ভূগোল এর সাহায্য নেওয়া হয়। ভূগোল এর মাধ্যমে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন টেলি স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। রোগীরা অনলাইনে তাদের সকল স্বাস্থ্যসংক্রান্ত রেকর্ড গুলো ইন্টারনেটে সংরক্ষণ করলে পরবর্তীতে তাদের যখনই প্রয়োজন পড়বে তখনই ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ পেতে পারেন। এই ধরনের টেলিস্বাস্থ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে MDLiveCare এবং Hello Health অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
গ) দূরবর্তী রোগী তদারকিঃ
দূরবর্তী রোগী তদারকি পদ্ধতির আওতায় বায়োমেট্রিক উপাত্তগুলো সংরক্ষণ করে তা পাঠানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের সেন্সর ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, টেলি- ইসিজি যন্ত্রটি রোগীর মস্তিষ্কে ইলেকট্রিক্যাল গতিপ্রকৃতি তদারকি করে এবং এই গতি রেখাগুলো একজন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এগুলো উপরোল্লিখিত real-time পদ্ধতির মাধ্যমেও সম্পন্ন করা যায় অথবা স্টোর এবং ফরওয়ার্ড অথবা সংরক্ষণ এবং প্রেরণের মাধ্যমেও চর্চা করা যায়।
দূরবর্তী তদারকি পদ্ধতির প্রক্রিয়াগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
১। আবাসন ভিত্তিক রাত্রিকালীন ডায়ালাইসিস।
২। আইসিইউ গুলোর অবস্থান যদি দূরবর্তী কোন জায়গায় হয় সেক্ষেত্রে হৃদরোগ চিকিৎসার জন্য।
৩। গৃহ কেন্দ্রিক টেলিস্বাস্থ্য চর্চা এবং
৪। রোগ নিরাময়ে ব্যবস্থাপনা।
টেলিস্বাস্থ্যের উপকারিতাঃ
যে সকল দেশের স্বাস্থ্য সেবার জন্য লোকজনকে দূরবর্তী জায়গায় যেতে হয় সে সকল দেশে টেলিস্বাস্থ্য খুবই কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে। নিজ নিজ এলাকায় যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব থাকে তাহলে টেলিস্বাস্থ্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। সাধারণত একটি দেশে কিংবা এলাকায় ডাক্তারের পর্যাপ্ততার উপর টেলিস্বাস্থ্যের প্রয়োজন নির্ভর করে। অনেক সময় সরকারি পদ্ধতি এবং বীমা কোম্পানিগুলোর পদ্ধতি গুলো টেলিস্বাস্থ্য প্রচলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।